“জনাব,নেতা মুহিব উল্লাহ: ভাষার পাঠ, জীবনের সংগ্রাম”
আমার ছাত্র মুহিব উল্লাহ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অগ্রগামী নেতা, প্রথম যখন বাংলা শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করল, আমি জানতাম এটি তার জন্য কেবল ভাষা শেখার বিষয় নয়। এটা ছিল তার জীবনের সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা শিখে জাতির কষ্টগুলো আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে। বয়সে ও জ্ঞানে জনাব নেতা মুহিব উল্লাহ ছিলেন আমার চেয়ে অনেক বড়, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে আমি তার শিক্ষক হতে পেরেছিলাম। সেই সময় আমাদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
প্রতিদিন আমাদের বাংলা শেখার পাশাপাশি আরও অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা হতো। পড়ার টেবিলে আমরা শুধু ভাষা নয়, কথা বলতাম বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, মানবাধিকার, রোহিঙ্গা জাতির অবস্থা নিয়ে। তার চিন্তাগুলো ছিল গভীর, প্রতিটি কথার পেছনে ছিল এক অসীম দায়িত্ববোধ। তবে এসব আলোচনা করতে করতে কখনও কখনও আমি দেখতাম, সে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে যেত। তার দায়িত্বের ভার তাকে কিছু সময়ে টেনশনে ফেলে দিত, এবং সেই সময়গুলোতে তার মনোযোগ হারিয়ে ফেলত।
একদিন সে ক্লাসের মাঝপথে হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখে গভীর উদ্বেগের ছাপ। তখন আমি বলেছিলাম কি হয়েছে আপনার শরীর খারাপ লাগছে নাকি? “আমার মানুষগুলো আজও প্রতিদিন লড়াই করছে। আমি সবসময় ভাবি, কীভাবে তাদের জন্য আরও ভালো কিছু করতে পারি।”
আমি তার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম। জানতাম, সে প্রতিনিয়ত এক অসম যুদ্ধের মধ্যে আছে। সে কেবল ভাষার জ্ঞান অর্জন করতে চাইছিল না, বরং সে চাইছিল সেই ভাষার মাধ্যমে জাতির অধিকারের পক্ষে একটি শক্তিশালী কণ্ঠ হতে। কিন্তু সেই বিশাল দায়িত্বের ভার তার মনে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করত।
আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, “আপনি আজ যা শিখছেন, তা কেবল আপনার জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য। ভাষা হচ্ছে শুধু এক মাধ্যম; আপনার মূল শক্তি আপনার অন্তর্নিহিত সাহস আর প্রতিজ্ঞা।”
তারপর আমরা আবার পড়ায় মন দিলাম। কিন্তু আমি দেখেছি, এমন অনেক দিন ছিল যখন নেতা মহিব উল্লাহর মাথার ওপর নানা দায়িত্বের বোঝা এত বেশি হয়ে যেত যে, সে পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারত না। তবুও, সে সবসময় চেষ্টা করত, এবং তার মধ্যে ছিল এক অদম্য শক্তি, যা তাকে বারবার সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেত।
মর্মান্তিক অধ্যায়: ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১। সেই দিন মুহিব উল্লাহর জীবন কেড়ে নেওয়া হলো। খবরটি পাওয়ার পর আমি থমকে গেলাম। আমার ছাত্র, যে ভাষা শিখে জাতির অধিকারের জন্য শক্ত কণ্ঠস্বর হতে চেয়েছিল, সে আজ আর নেই। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন, তার সংগ্রাম, আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছে।
আমি একদিন হঠাৎ একটা প্রশ্ন করলাম।
“আপনি কেন মানবাধিকারের জন্য লড়াই শুরু করছেন”?
সেই গভীর শ্বাস নিলেন এবং বললেন, “আমাদের রোহিঙ্গা জাতির হাজারো মানুষের কষ্ট দেখে আমি বুঝেছিলাম, কেউ না কেউ তো কথা বলতে হবে। ন্যায়বিচারের জন্য, মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য কেউ না কেউ তো দাঁড়াতে হবে। আমি সেই কেউ হতে চাচ্ছি।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে। তার চোখে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কষ্ট, কিন্তু তার মধ্যেও ছিল এক অদম্য সাহস। নেতা মহিব উল্লাহ কেবল একজন নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন জাতির একজন বন্ধু বটে।
আমি জানি, মুহিব উল্লাহর সেই দিনের চিন্তাগুলো, তার টেনশন, তার লড়াই এসবের কোনো কিছুই বৃথা যায়নি। সে তার সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি আলোকিত পথ দেখিয়ে গেছে, যা আজও আমাদের পথপ্রদর্শক।
শেষ কথা: মুহিব উল্লাহ আমার ছাত্র ছিল ভাষার ক্ষেত্রে,কিন্তু আজ সে আমাদের সবার শিক্ষক হয়ে উঠেছে। তার দেখানো পথই আমাদের জাতির আলো। আল্লাহ্ তা’য়ালা তার আত্মা শান্তিতে থাকু, এবং তার সংগ্রামের আলো আমাদের জীবনে চিরদিন জ্বলতে থাকুক। জীবনের শিক্ষায় সে আমার চিরন্তন শিক্ষক। আমাদের টেবিলে শুধু ভাষার পাঠ নয়, জাতির কষ্ট আর সংগ্রামের গল্পগুলোও বলা হতো। আজ তার সেই পথ আমরা অনুসরণ করছি, এবং তার সংগ্রামের আলো আমাদের সবার মাঝে জ্বলতে থাকবে।
সিরাজুল হক আবরার
পাঠকের মতামত